চিয়া সিড: প্রাচীন সোনার সমতুল্য আধুনিক সুপারফুড

চিয়া সিড বা চিয়া বীজ হচ্ছে মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া হিসপানিকা (Salvia Hispanica) উদ্ভিদের বীজ, যা সেন্ট্রাল আমেরিকায় জন্মেছিল। প্রাচীন মায়া এবং অ্যাজটেক জাতির খাদ্য তালিকায় এই বীজের বিশেষ স্থান ছিল। তারা চিয়া সিডকে সোনার থেকেও মূল্যবান মনে করত এবং বিশ্বাস করত এটি তাদের শক্তি ও সাহস যোগাবে।

চিয়া সিডের পরিচিতি এবং পুষ্টিগুণ

চিয়া সিড হলো একটি সুপারফুড, যা বিভিন্ন আবহাওয়ায় জন্মাতে পারে এবং এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন হয় না। চিয়া বীজের দুটি রং রয়েছে—সাদা এবং কালো। এটি দেখতে তিলের মতো ছোট সাইজের।

চিয়া সিড বনাম তোকমা

চিয়া সিড এবং তোকমা (বেসিল সিড) নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে। অনেকেই তোকমাকে চিয়া সিড মনে করেন। যদিও এদের পুষ্টিগুণ প্রায় একই, তোকমার তুলনায় চিয়া সিড সাইজে ছোট।

পুষ্টিগুণ

চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক এসিড, এবং ক্যাফিক এসিড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এছাড়া, এতে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় আঁশও থাকে।

ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (USDA) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া সিডে রয়েছে:

  • ৪৮৬ ক্যালোরি
  • ৬% পানি
  • ৪২.১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট
  • ৩৪.৪ গ্রাম ফাইবার
  • ১৬.৫ গ্রাম প্রোটিন
  • ৩০.৭ গ্রাম ফ্যাট
  • ০% গ্লুটেন

চিয়া সিডে দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, পালং শাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশি আয়রন, কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম এবং স্যামন মাছের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ওমেগা-৩ থাকে।

চিয়া সিডের উপকারিতা

চিয়া সিডের অসাধারণ সব উপকারিতা রয়েছে, যা আমাদের দেহের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার করতে পারে।

১. ওজন কমাতে সহায়ক

চিয়া সিডে উচ্চমাত্রার ফাইবার এবং প্রোটিন থাকায় যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এটি খুব উপকারী। প্রতি ২৮ গ্রাম চিয়া সিডে ১০ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যচাহিদার প্রায় ৩৫% পূরণ করে। এই ফাইবার পাকস্থলীতে গিয়েও দীর্ঘসময় পেট ভরা রাখে, ফলে ক্ষুধা কম লাগে।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

চিয়া সিডে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।

৩. শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি

প্রাচীন মায়া এবং অ্যাজটেক জাতির মতোই আজকের দিনে চিয়া সিডকে শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির একটি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।

৪. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ

চিয়া সিড ব্লাড সুগার স্বাভাবিক রাখে, ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।

৫. হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা

চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান থাকে, যা হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।

৬. কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ

চিয়া সিড মলাশয় পরিষ্কার রাখে এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

৭. শরীর থেকে টক্সিন বের করে

চিয়া সিড শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়।

৮. প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করে

চিয়া সিড প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।

৯. ভাল ঘুমে সহায়তা

চিয়া সিড ভাল ঘুম হতে সাহায্য করে।

১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ

চিয়া সিড ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

১১. হজমে সহায়তা

চিয়া সিড হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

১২. হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা দূর করে

চিয়া সিড হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা দূর করতে সহায়ক।

১৩. ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর রাখে

চিয়া সিড ত্বক, চুল ও নখের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম

চিয়া সিড খাওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এটি রান্না করা লাগে না বরং কিছু নির্দিষ্ট খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।

১. স্মুদি

ফল এবং সবজির স্মুদিতে চিয়া সিড মিশিয়ে পান করা যায়।

২. সালাদ

সালাদের উপরে চিয়া সিড ছিটিয়ে খাওয়া যায়।

৩. ড্রিংকস

চিয়া সিড পানিতে মিশিয়ে অথবা জুসের সাথে পান করা যায়।

৪. টকদই এবং সিরিয়াল

চিয়া সিড টকদই এবং সিরিয়ালের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।

৫. রান্না করা সবজি

রান্না করা সবজির উপরে চিয়া সিড ছিটিয়ে খাওয়া যায়।

চিয়া সিডের অপকারিতা

চিয়া সিডের অনেক উপকারিতা থাকলেও, অতিরিক্ত গ্রহণে কিছু অপকারিতা হতে পারে।

১. গ্যাস এবং ফোলাভাব

চিয়া সিডের উচ্চ ফাইবারের কারণে অতিরিক্ত গ্রহণে গ্যাস এবং ফোলাভাব হতে পারে।

২. অ্যালার্জি

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে চিয়া সিড অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।

৩. ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া

কিছু ওষুধের সঙ্গে চিয়া সিডের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই ওষুধ গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

চিয়া সিডের রেসিপি

চিয়া পুডিং

উপকরণ:

  • ১/৪ কাপ চিয়া সিড
  • ১ কাপ দুধ
  • ১ টেবিল চামচ মধু
  • ফল এবং বাদাম

প্রস্তুত প্রণালী:

১. একটি বাটিতে চিয়া সিড এবং দুধ মিশিয়ে নিন। ২. মধু যোগ করুন এবং ভালভাবে মেশান। ৩. মিশ্রণটি ফ্রিজে রেখে দিন ৪-৫ ঘণ্টা বা রাতভর। ৪. ফ্রিজ থেকে বের করে উপরে ফল এবং বাদাম যোগ করুন। ৫. প্রস্তুত চিয়া পুডিং উপভোগ করুন।

চিয়া সিড কেন খাবেন?

চিয়া সিডের অসাধারণ পুষ্টিগুণ এবং বহুমুখী ব্যবহারের কারণে এটি আমাদের খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত। এটি শুধু আমাদের দেহের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করে।

আজকের দিনে, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হলে চিয়া সিডের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই চিয়া সিডকে আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন এবং উপভোগ করুন এর অসাধারণ সব উপকারিতা।

Leave a Comment