চাদঁনী ঘাটের সিড়িঁ, আলী আমজাদের ঘড়ি, বঙ্কু বাবুর দাড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ি। সিলেটের পরিচিতিতে বহুল প্রচলিত এমন একটি লোকগাঁথা। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জিতু মিয়ার বাড়ীটি এহিয়া ভিলা নামেও পরিচিত।
সিলেট নগরীর শেখঘাটে কাজীর বাজারের দক্ষিণ সড়কের ধারে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভুমি জুড়ে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই জিতু মিয়ার বাড়ি। চুনের সুরকি দিয়ে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন এ দালানটি নির্মাণ করেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া।
১৮৯১ সালে এ বাড়ির সামনের দালানটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের বর্তমানে কাজিরবাজার গরুর হাট ছিল কাজিদের মূল বাড়ি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বাড়িটি লন্ডভন্ড হয়ে গেলে বর্তমানের জায়গায় বাড়িটি স্থানান্তরিত হয়।
খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া(১৮৫১-১৯২৫) প্রথম জীবনে কিছু দিন সাব রেজিস্টার ছিলেন। পরে তিনি এ চাকরিটি ছেড়ে দেন। ১৮৯৭ থেকে ১৯০৩ সাল পযর্ন্ত তিনি সিলেট পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন পাশাপাশি ছিলেন অনারারী ম্যাজিস্টেটও।
জিতু মিয়ার পরিবারের জাকঁজমক চলাফেরা ও বিলাসী জীবন যাত্রা ছিল সে কালের এক অন্যতম আলোচিত বিষয়। কথিত আছে, জিতু মিয়ার পরিবারে ১২২টি চুলোয় রান্নাবান্না হতো। প্রতিদিন জরুরী প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গ্রাম থেকে শহরে আসা শত শত মানুষ জিতু মিয়ার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন।
খাঁন বাহাদুর জিতু মিয়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার চাচাতো বোন সারা খাতুন। সারা খাতুন ছিলেন তার চাচা মাওলানা আব্দুল রহমানের মেয়ে। সারা খাতুনের অকাল মৃত্যুতে ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা রসুল বক্সের মেয়েকে জিতু মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ স্ত্রীও অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের ঘরে কোনো সন্তান সন্তনি ছিল না। তবে জিতুর মৃতুর পরবর্তীকালে জিতু মিয়ার আরও বিয়ে ছিল বলে জানা যায়।
সে সব স্ত্রীর ঘরে তার বহু সন্তান সন্ততি রয়েছে বলে অনেকে দাবি করেন। কিন্তু দুরদর্শী জিতু মিয়া তার জমিদারি ও বিশেষ করে আলীশান বাড়িটির অস্তিত্ব চিরদিন অক্ষত রাখান লক্ষ্যে মৃত্যুর আগে ১৯২৪ সালে নিজেকে নিঃসন্তান উল্লেখ করে তৎকালীন আসাম সরকারের অনুমোদন নিয়ে তারঁ যাবতীয় সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেন।
কে বি এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট নামে এস্টেট এর মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। পরবর্তীতে সিলেট বিভাগে উন্নীত হলে বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে এ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, মৌলভী আবু নছর মোহাম্মদ ইদ্রিছ কাজী হয়ে সিলেট আসেন নবাবী আমলে।
সুরমা নদীর তীরে তারঁ বিচারালয়কে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে গড়ে উঠে একটি গঞ্জ। লোকজন একে খানবাহাদুর গঞ্জ বাজার বলে ডাকতো। তার মৃত্যু পর তার পুত্র মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুর কাদির ও মাওলানা আবুল হোসাইন মোহাম্মদ আব্দুর রহমান তাদের বিশাল জায়গীরকে কেন্দ্র করে জমিদারি এস্টেট গড়ে তোলেন কে বি এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট থেকে বিভিন্ন সমাজ সেবা মুলক কাজ , ধর্মীইয় কাজ ,শিক্ষা মুলক কাজে অনুদান ,দান ও বৃত্তি প্রদান করা হয় ।
উল্লেখ যে খান বাহাদুর তার সম্পত্তির ৬০% সমাজ সেবা ,ধর্মিয় কাজ , শিক্ষা মুলক কাজে দান করে গেছে ন।। সিলেট সার্কিট হাউস গঠনের আগে খান বাহাদুরের বসত বাড়ি “জিতু মিয়ার বাড়ি” “এহিয়া ভিলা” “সাব বাড়ি”, “কাজি বাড়ি” তে উপমহাদেশের খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দ – মহাত্মা গান্ধী , ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ,ভারতের সাবেক রাষ্টপতি জনাব ফখরুউদ্দিন আলি আহমেদ, আসামের সাবেক গভর্নর স্যার সাদ উল্লাহ ,ভারতের সাবেক আই সি এস খান বাহাদুর গজনফর আলি, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্তী খাজা নাযিম উদ্দিন, মজলুম নেতা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, রাজনিতিবিদ ফরিদপুরের লাল মিয়া, মোহন মিয়া, উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলেম দীন মওলানা হসসাইন আহমেদ মাদানি, মাওলানা সহুল আহমেদ উসমানী, ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হাজী শরিয়াত উল্লাহর উত্তরসূরী বাদশা মিয়া, পীর মুসলে উদ্দিন, দুদু মিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আম এম এ জি ওসমানী, সহ উপমহাদেশের নামকরা ব্যাক্তি রা এই বাড়িতে থেকেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক করেচেন, বহু সভা সম্মেলন করেছেন। ব্রিটিশ-পাকিস্তান সময়ে সিলেট তথা উপমহদেশের রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই বাড়ি ।
বর্তমান অবস্থা বাড়ীটির মুল কক্ষটি ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহৃৎ হতো যেখানে রয়েছে জিতু মিয়ার সংগৃহিত ক্যালিওগ্রাফি করা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাণী। এই কক্ষের ডান দিকের অপর একটি কক্ষে রয়েছে একটি লম্বা কালো টেবিল ও ২০টি চেয়ার, যা তৎকালীন সময়ে সভা কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃৎ হতো ।
বাড়ির ভিতর এ র অংশে আছে ৮ টি বসত ঘর যাতে জমিদার বংগশের বসবাস করেন। তাদের অনেকেই নিজ নিজ যায়গায় দেশে বিদেশে সুনাম রাখছেন। বর্তমানে নানা কারনে এই বাড়ির ইতিহাস সবার নজরের বাহিরে চলে যাচ্ছে । আমি এই ঐতিহাসিক বাড়ির একজন সদস্য হিসাবে গর্বিত । এই বাড়ির মানুষের বসবাসের বিঘ্ন, এবং তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে বিঘ্ন না করে যেভাবে এই বাড়ির ইতিহাস তুলে ধরা যায় তাই করা উচিত।