মূলপাতা » দরকারি » হাত-পায়ের কড়া: কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়াভাবে দূর করার উপায়

হাত-পায়ের কড়া: কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়াভাবে দূর করার উপায়

দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে চামড়ার নির্দিষ্ট কিছু অংশ শক্ত হয়ে যায় এবং এর ফলে হাত ও পায়ে কিছু অংশে এক ধরনের দাগ পড়ে যায়। এই অবস্থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে “কড়” বা “কড়া” বলা হয়। ইংরেজিতে একে বলা হয় কর্ন বা ক্যালাস (Calluses)। কড়ার উপর সরাসরি চাপ লাগলে প্রচণ্ড ব্যথা লাগে। তবে, এই সমস্যার সমাধানে কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে।

কড়া পড়ার কারণ

স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কড় বা কড়া পড়ার কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো:

  • বেশি হাঁটাচলা বা দৌড়ানো: অতিরিক্ত হাঁটা বা দৌড়ানোর ফলে পায়ের নির্দিষ্ট অংশে চাপ পড়ে এবং কড়া তৈরি হয়।
  • সঠিক মাপের স্যান্ডেল বা জুতা না পরা: অসঠিক মাপের জুতা বা স্যান্ডেল পরার কারণে পায়ের নির্দিষ্ট অংশে ঘর্ষণ হয়, যা কড়া পড়ার প্রধান কারণ।
  • হাতে গ্লাভস না পরে ব্যায়াম করা: ভারী ওজন তোলা বা ব্যায়াম করার সময় গ্লাভস না পরার ফলে হাতে কড়া পড়ে।
  • অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা: দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার কারণে পায়ের নির্দিষ্ট অংশে চাপ পড়ে কড়া তৈরি হয়।
  • শারীরিক কাজ: কিছু কাজ যেমন—মিস্ত্রির কাজ, কৃষিকাজ, কিংবা অন্য যেকোনো হাতের কাজ যেখানে ত্বকে বেশি চাপ পড়ে।
  • ত্বক কেটে যাওয়া: ত্বক কেটে গেলে সেই জায়গায় কড়া তৈরি হতে পারে, যা সাধারণ কড়া থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

বিশেষজ্ঞের মতামত

সাজসজ্জা-বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতীয় রূপচর্চা বিশেষজ্ঞ আনিতা গোলানি জানিয়েছেন, কড়া নিয়ে কিছু তথ্য। তিনি বলেন, “কড়া পড়ার সমস্যা হলে প্রথমেই আক্রান্ত জায়গায় বিশেষ যত্ন নিতে হবে এবং প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য অবশ্যই অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। 

কড়া সাধারণত পায়ের পাতা, গোড়ালি, কনুই, হাত, কিংবা পায়ের আঙুলে দেখা দেয়। এর আকৃতি বিভিন্ন রকমের হতে পারে, তবে ব্যথাযুক্ত কড়া সাধারণত বৃত্তাকার হয়।

এই ধরনের কড়ার ক্ষেত্রে প্রথমে আক্রান্ত অংশে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে, পায়ে হলে জুতা পরতে বা হাঁটার সময় ব্যথা অনুভূত হয়। ধীরে ধীরে ত্বকের আক্রান্ত অংশটি শক্ত হয়ে দানা বাঁধতে শুরু করে।

সাধারণ কড়া কালো রঙের হয়, তবে ব্যথাযুক্ত কড়া সাধারণত হলুদ বর্ণ ধারণ করে। সাধারণ কড়ায় ত্বক শুধু পুরু হয়, কিন্তু ব্যথাযুক্ত কড়ার মাঝে ত্বকের প্রদাহ থাকে।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কড়া তুলনামূলকভাবে বেশি মারাত্মক হতে পারে। পায়ে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা থাকলে সামান্য কড়া ভয়ংকর সমস্যা তৈরি করতে পারে। আক্রান্ত অংশ নিয়মিত পরিষ্কার করা এবং ময়েশ্চারাইজ করার মাধ্যমে কড়া সহজেই দূর করা যায়।

কড়ার লক্ষণ

কড়া পড়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

  • পায়ের বা হাতের চামড়ার নির্দিষ্ট অংশ শক্ত হয়ে যাওয়া।
  • চামড়ার অংশটি রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
  • আক্রান্ত অংশে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া অনুভূত হওয়া।

হাত-পায়ের কড়া দূর করার ঘরোয়া উপায়

কড় সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

আরামদায়ক জুতা পরা

পায়ের মাপ অনুযায়ী আরামদায়ক জুতা পরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুতা যেন অতিরিক্ত ঢিলেঢালা বা বেশি আঁটসাঁট না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এইভাবে পায়ে অনবরত চাপ পড়া বন্ধ হলে আস্তে আস্তে কড়া সেরে যাবে।

লেবুর রস এবং অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট

লেবুর রসে আছে সিট্রাস অ্যাসিড এবং অ্যাসপিরিনে আছে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড যা চামড়ার শক্ত অংশ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। লেবু সব ধরনের কড়া দূর করতে কার্যকর। বিশেষ করে ব্যথাযুক্ত কড়ার ক্ষেত্রে, যেখানে অভ্যন্তরীণ প্রদাহ বেশি থাকে। তাজা লেবুর রস সরাসরি কড়ার মাঝখানে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত লেবুর রস ব্যবহারে এক পর্যায়ে কড়াটি শক্ত হয়ে খসে পড়বে। লেবুর রসে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, তাই যতবার খুশি ব্যবহার করা যায়।

পদ্ধতি:

  • ছয়টি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট গুঁড়া করুন।
  • আধা চামচ লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে পানি দিয়ে পেস্ট তৈরি করুন।
  • এই মিশ্রণ একটি পরিষ্কার তুলা বা পাতলা কাপড়ের সাহায্যে আক্রান্ত অংশে লাগান।
  • পরিষ্কার কাপড় বা প্লাস্টিকের সাহায্যে কিছু সময়ের জন্য ঐ অংশ পেঁচিয়ে রাখুন এবং শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
  • ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর মিশ্রণটি পিউমিক স্টোন বা পা ঘষুনির সাহায্যে আলতোভাবে ঘষে উঠিয়ে নিন এরপর পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।

টি ট্রি তেল এবং অ্যাপল সাইডার ভিনিগার

এই উপাদানগুলোতে আছে ব্যাকটেরিয়ারোধী এবং জীবাণুনাশক উপকরণ যা কড়া পড়া শক্ত চামড়া নরম করে তুলতে সাহায্য করে।

পদ্ধতি:

  • মৃদু গরম পানিতে সামান্য বেকিং সোডা পাউডার মিশিয়ে তাতে পা ভিজিয়ে রাখুন।
  • কিছু সময় পর, পা তুলে ভালোকরে মুছে নিন।
  • অ্যাপল সাইডার ভিনিগারে তুলা ভিজিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া চামড়ার মধ্যে লাগান।
  • কিছু সময় পর তার উপর আলতো করে টি ট্রি অয়েল লাগান।
  • ধারাবাহিকভাবে কয়েকদিন এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে কড় পড়ে শক্ত হয়ে যাওয়া অংশ আলগা হয়ে উঠে যাবে।

জলপাই তেল এবং ভিটামিন ই ক্যাপসুল

চামড়া কোমল ও সুন্দর রাখতে জলপাই তেল এবং ভিটামিন ই ক্যাপসুল অত্যন্ত কার্যকর। জলপাই তেলে আছে অলিয়েক অ্যাসিড যা চামড়ার গভীরে গিয়ে কড়া সারিয়ে তুলতে সহায়তা করে। ভিটামিন ই আক্রান্ত স্থানের ত্বক নরম করে কড়া সারাতে সহায়তা করে। ভিটামিন ইর ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ গুণ দ্রুত কড়া সারাতে সাহায্য করে।

পদ্ধতি:

  • দুটি ভিটামিন ই ক্যাপসুলের সাথে জলপাই তেলে মিশ্রণ তৈরি করুন।
  • হালকা গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট পা ভিজিয়ে রাখুন।
  • পা তুলে ভালোভাবে মুছে নিন।
  • কড়া পড়ে শক্ত হয়ে যাওয়া জায়গায় মিশ্রণটি মালিশ করুন।
  • প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যান যতদিন না এটি পুরোপুরি ভালো হয়।

কড়া সমস্যা সমাধানের ঘরোয়া পদ্ধতি

রসুন

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় রসুনের ঔষধি গুণের কথা উল্লেখযোগ্য। কড়াকে গোড়া থেকে নির্মূল করতে রসুন বেশ কার্যকর। রসুনের ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ উপাদান কড়ার ভেতরের প্রদাহ ও সংক্রমণ দ্রুত সারায়। এজন্য রসুন বাটা সরাসরি কড়ার উপর মাখিয়ে রাতভর রাখতে হবে। পরে কুসুম গরম পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে।

পেঁয়াজ

পেঁয়াজের অম্লীয় উপাদান কড়া সারাতে অত্যন্ত কার্যকর। এর রস নিয়মিত ব্যবহারে শক্ত হয়ে যাওয়া চামড়ার স্তর সহজেই উঠিয়ে ফেলা যায়। আক্রান্ত স্থানে পেঁয়াজের রস মেখে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে দুই দিন ঢেকে রাখতে হবে। এতে ত্বক নরম হয়ে কড়া সেরে যাবে।

বেইকিং সোডা

ত্বকের মৃতকোষ পরিষ্কার করতে বেইকিং সোডা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কড়া সারাতে বেইকিং সোডা মেশানো কুসুম গরম পানিতে পা ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর আক্রান্ত অংশ নরম হলে ঘষে কড়া পরিষ্কার করা যাবে।

ক্যাস্টর অয়েল

শুষ্ক ত্বকের জন্য ক্যাস্টর অয়েল অত্যন্ত উপকারী। কুসুম গরম পানিতে তরল সাবান আর ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে তাতে পা ডুবিয়ে রাখতে পারেন। অথবা পাথর ডুবিয়ে তা দিয়ে কড়া পড়া অংশ আলতোভাবে ঘষে নিতে পারেন।

আনারসের খোসা

আনারসের খোসার অম্লীয় উপাদান কড়া দূর করতে সহায়ক। কড়া পড়া অংশে আনারসের খোসা বেঁধে সারারাত রাখতে হবে। খোসা খুলে ত্বক পরিষ্কার করে সেখানে নারিকেল তেল মাখতে হবে।

এই ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে আপনি কড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। নিয়মিত ব্যবহার এবং যত্নে আপনার ত্বক সুস্থ ও সুন্দর থাকবে।

অতিরিক্ত কিছু টিপস

পিউমিক স্টোন ব্যবহার

প্রতিদিন গোসলের সময় বা পা ভেজানোর পরে পিউমিক স্টোন দিয়ে আক্রান্ত অংশটি আলতোভাবে ঘষুন। এতে করে চামড়ার মরা কোষগুলো দূর হবে এবং কড়া নরম হবে।

মোজা পরা

সঠিক মাপের এবং নরম মোজা পরার মাধ্যমে পায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। এতে করে পায়ে ঘর্ষণ কম হবে এবং কড়া পড়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।

গ্লাভস ব্যবহার

যে কোনো ধরনের ভারী কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস ব্যবহার করুন। এটি হাতে কড়া পড়া থেকে রক্ষা করবে।

এই ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো নিয়মিত অনুসরণ করলে হাত ও পায়ের কড়া সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। উপরে উল্লেখিত পদ্ধতি মেনে আপনার পায়ের সঠিক যত্ন নিলে এবং যথা সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কড়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হবে।

শেষকথা

কড়া পড়া একটি সাধারণ কিন্তু কষ্টদায়ক সমস্যা। ত্বকের সঠিক যত্ন, অভ্যাসের পরিবর্তন এবং প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিশেষত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কড়ার যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাই সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

Leave a Comment